কলেজে ভর্তি হওয়ায় নির্যাতন গৃহবধূকে অবশেষে আত্মহত্যা

  • নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ঢাকার নিকটে সাভারে মোফাজ্জল মোমেনা চাকলাদার মহিলা ডিগ্রি কলেজে এ ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে পড়াশুনার তাগিদে কলেজে ভর্তি হওয়ায় স্বামী, শশুর ও ননদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মারজাহান আক্তার (২০) নামে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৮ টার পর সাভার পৌরসভার দক্ষিণ দরিয়ারপুর ১২৮/১০ নং ফ্লাটের চতুর্থ তলায় এই ঘটনা ঘটে।

খবর পেয়ে পুলিশ ওইদিন রাতে ঘটনাস্থল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। পরে প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির পর ময়নাতদন্তের জন্য রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় সাভার মডেল থানা পুলিশ।

মঙ্গলবার সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা।

পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ৯ মাস আগে লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানার গন্ধব্যপুর গ্রামের প্রবাসী মোঃ রেজওয়ানুল রহমানের মেয়ে মারজাহান আক্তারের সঙ্গে লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার লাহারকান্দি গ্রামের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অবসরপ্রাপ্ত কেরানি নুরুল আমিনের ছেলে রাশেদুল ইসলাম খান ওরফে রাশেদের সঙ্গে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়।

মারজাহান আক্তার গ্রামের গন্ধব্যপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে মান্দারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি, লক্ষ্মীপুর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ২০২২ সালে এইচএসসিতে কৃতিত্বের সাথে পাস করে স্বামীর বাড়ি সংলগ্ন সাভারের মোমেনা চাকলাদার মহিলা কলেজে ডিগ্রী প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন।

গৃহবধূ মারজাহান আক্তারের শশুর নুরুল আমিন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করার সুবাদে সাভারে স্থায়ী হন। পরে এখান থেকে অবৈধ উপায়ে অঢেল সম্পদ অর্জন করে অবসর গ্রহণ করে বসবাস শুরু করেন। মেয়ের খালু সাভারের বাসিন্দা হুমায়ুন কবিরের মাধ্যমে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে নুরুল আমিনের ছেলে রাশেদুল ইসলাম খান ওরফে রাশেদের সঙ্গে বিবাহ হয়।

বিয়ের কদিন পরই গৃহবধূ মারজাহান আক্তার জানতে পারেন তার স্বামী রাশেদুল ইসলাম খান ওরফে রাসেল তন্নী নামের এক তরুণীর সঙ্গে পূর্বের বিয়ে গোপন রেখে তাকে বিয়ে করে। বিষয়টি পরিবারকে জানালে যৌতুকসহ বিভিন্ন অজুহাতে রাশেদুল ইসলাম খানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা মারজাহানকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করে। ধীরে ধীরে মারজাহানের স্বামী রাশেদুল ইসলাম খান ওরফে রাশেদ ও শ্বশুর নুরুল আমিননের অপকর্ম বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

এই নিয়ে দুই পরিবারের মাঝে টানাপোড়েন শুরু হয়। বিয়ের ৮ মাসের মাথায় দুইবার মারধর করে মারজাহানকে বাবার বাড়ি যেতে বাধ্য করা হয়। মেয়ের সুখের জন্য গলার হার, কানের দুল, ছেলের জন্য আংটি, ছেলের ভাই রাকিবের জন্য আংটি, মারজাহানের ননদ অন্তুর জন্য আংটি সহ ৫০ হাজার টাকা নগদ দিয়ে আরো বেশ কয়েকবার সাধ্য অনুযায়ী ছেলের দাবি পূরণ করে আপস মীমাংসা করে মারজাহানের পরিবার।

সর্বশেষ একমাস পূর্বে বিবাদ মীমাংসা করে কলেজে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্যে সাভারে স্বামীর বাড়ি আসেন গৃহবধূ মারজাহান। ভর্তির জন্য আবেদন করে অনলাইনে চান্স পাওয়ায় বৃহস্পতিবার ১৯ জানুয়ারি সকালে সাভারের মোমেনা চাকলাদার মহিলা কলেজের ডিগ্রী প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার জন্য কলেজে যায় মারজাহান। পরে বিষয়টি জানতে পেরে তার স্বামী রাশেদুল ইসলাম খান ওরফে রাশেদ কলেজের শিক্ষক ও অন্যান্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সামনেই অপমান অপদস্ত করে বোরকার মুখোশ খুলে নির্যাতন করার পর পড়ালেখা বন্ধের চাপ প্রয়োগ করেন। বিষয়টি তার শশুর নুরুল আমিন ও ননদ অন্তুকে জানায় মারজাহান। একথা জানার পর তারাও ক্ষুব্ধ হয়ে মারজাহানকে অকথ্য গালিগালাজ করেন। স্বামী, শশুর ও ননদের এ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বৃহস্পতিবার রাতে গলায় ওড়না ও গামছা পেঁচিয়ে ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে মারজাহান আক্তার।

এ ঘটনায় শুক্রবার মারজাহান আক্তারের মা পারভিন আক্তার বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় মেয়ের জামাই রাশেদুল ইসলাম খান (২৫), মারজাহানের ননদ অন্তু (২৩), শশুর নুরুল আমিন (৬১)কে আত্মহত্যা প্ররোচনায় অভিযুক্ত করে অভিযোগ দায়ের করেন। পরে মামলা হলে গৃহবধূ মারজাহানের স্বামী সাভার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নকলনবীশ রাশেদুল ইসলাম খান ওরফে রাশেদকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গৃহবধূ মারজাহান আক্তারের শশুর লক্ষ্মীপুর জেলার নাহার কান্দি গ্রামের মৃত গোলাম রহমানের ছেলে নুরুল আমিন নকলনবীশ হিসেবে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে চাকুরী শুরু করেন। সেই সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে সার্ভিস দেন। টাকার রাজ্যে প্রবেশ করায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সাভার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নকলনবীশ হিসেবে দীর্ঘদিন চাকুরি করেন। পরে কেরানি পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০২০ সালে অবসরে যান। চাকুরী জীবনে অবৈধ উপায়ে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন নুরুল আমিন। তার মধ্যে সাভারের মুক্তির মোড় এলাকায় ৮ শতক জমির উপর বাড়ি, এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সংলগ্ন পৃথক ১১ শতাংশের উপর বাড়ি, মডার্ন প্লাজার পেছনে ১৮ শতাংশের উপর বহুতল ভবন, গেন্ডা এলাকায় ৫ শতাংশের উপর বাড়ি, দরিয়ারপুর তারা মসজিদ সংলগ্ন ছয়তলা বহুতল ভবনসহ প্রায় ২শ কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন নুরুল আমিন। সেই ভবনের চতুর্থ তলায় নিজেকে আত্মহূতি দেন মারজাহান আক্তার।

বৈবাহিক জীবনে নুরুল আমিন ৫ টি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রী আমেনা বেগমকে ৩ মাসের মাথায় তালাক দিয়ে রাশেদুল ইসলাম খান ওরফে রাশেদের মা চাহেরা বেগমকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে তাকে ২০০৭ সালে হত্যার অভিযোগ উঠে নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে। এরপর রাশেদা খাতুনের সঙ্গে ৬ মাস, সুলতানা বেগমের সঙ্গে ৩ মাস সংসার করে তাদের তালাক দেন। সর্বশেষ সুমি আক্তার নামের এক তরুণীকে বিয়ে করেন নুরুল আমিন। বর্তমানে তার সঙ্গে সংসার জীবনে রয়েছেন এই বহুবিবাহের চতুর পন্ডিত । বর্তমানে পুত্রবধূকে আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলায় পলাতক রয়েছেন তিনি।

সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে নানা উপায়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মোঃ আব্দুর রহিম রাজু জানান, খবর পেয়ে তিনি গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করে প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে থানায় নিয়ে আসেন। পরে লাশের ময়নাতদন্তের জন্য রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। নিহতের মা বাদী হয়ে মামলা করলে মারজাহানের স্বামী রাশেদুল ইসলাম খান ওরফে রাশেদকে গ্রেফতার করে তাকে ৩ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে তৎপরতাসহ বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *