সিনিয়র সাংবাদিক
দুর্নীতি বিরোধী শুদ্ধি অভিযানের জ্বরে কাঁপছে দেশ। জনমনে স্বস্তির ঢেকুর। তবে যারা দুর্নীতির মাধ্যমে টাকাকড়ি অর্জন করে অল্পদিনে ধনী হয়েছেন তাদের ঘুম হারাম। অবশ্য সরকার ক্যাসিনো ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে শুদ্ধি অভিযান সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দিলেও সম্প্রতি তা থমকে গেছে। ঢাকা ও চট্টগামে ৫০টি অভিযান হলেও জেলা, উপজেলা ও পৌর এলাকায় নেই কোনো অভিযান। সারাদেশে দুর্নীতির ডালপালা ছড়িয়ে পড়লেও জেলা-উপজেলা ও পৌর এলাকায় জড়িতরা আইনের আওতায় না আসায় অভিযানের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিদায়ী বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে প্রথম ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর আর কোনো অভিযানের খবর পাওয়া যায়নি। যদিও সারাদেশে কয়েক হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তদন্ত করছে র্যাব, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, প্রতিদিন ডাকযোগে ও নানা মাধ্যমে শত শত অভিযোগ জমা পড়ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে। সেগুলো প্রকাশ্যে ও গোপনে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। দুই মাসে মোট ৫০টি ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি র্যাবের। বাকি ২০টি পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার। ১টি অভিযান রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। ঢাকায় ৩০টি ও চট্টগ্রামের মোট ১১টি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। ৫০টি অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৭৫ জন। এর মধ্যে ২২৩ জন ঢাকায়। আর বাকি ৫৩ জন ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অধিকাংশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২ জন, ঢাকার ৩ কাউন্সিলর, যুবলীগের ৬ জন ও কৃষক লীগের ১ জন। সরকার ও দুদক কর্তৃক দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আছে ৩৪ জনের বিরুদ্ধে। তালিকায় রয়েছে সংসদ সদস্যের নামও।
শুদ্ধি অভিযানে ৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা নগদ, ১৬৬ কোটি টাকার এফডিআর, ১৩৩টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক, ৮ কেজি সোনা, ২৭টি অস্ত্র এবং সাড়ে ৪ হাজার বোতল মদ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে ৫টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ। অভিযান শুরু হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন এরই মধ্যে প্রভাবশালী ২৩ ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬০০ ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে। এ ছাড়া আরো ৫০০ ব্যক্তির বিষয়ে তদন্ত করছে দুদকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থা। ওই ৫০০ ব্যক্তির মধ্যে রয়েছেন সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাসহ আরো অনেকে।
রাজধানী ছাড়াও দেশের কয়েকটি শহরে শুদ্ধি অভিযানে আঁচ লাগলেও ঢাকার পাশের উপজেলা সাভারে এর কোনো বাতাস লাগেনি। অথচ গত এক দশকে বা এক যুগে সাভার-আশুলিয়ার হাতেগোনা কয়েক ডজন লোক যেন আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন। পাল্টে গেছে তাদের জীবনযাত্রার ধরন। সম্পদ গড়েছেন দেশে-বিদেশে। সন্তান পড়ালেখা করাচ্ছেন নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দামি গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি হয়েছে বেহিসাবী আয়ে। অথচ কর অঞ্চল-১২ এর সাভার-আশুলিয়া সার্কেল (সাভার-২৫৮ ও আশুলিয়া-২৫৯) অফিসের হিসাব মতে তাদের আয়কর নথি বড়ই দুর্বল। সম্পদের তথ্য গোপন করে কোনমতে আয়কর নথি সামলাচ্ছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যাও সাভার-আশুলিয়ায় অনেক। সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যারা নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ছাড়াও অদৃশ্য ব্যবসার নামে টাকার কুমির হয়েছেন এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন। তবে তারা অধরা থাকায় শুদ্ধি অভিযানে স্বস্তি নেই এই অঞ্চলে। রাজনীতির খোলস পাল্টে ক্যাসিনো খেলোয়াড়, দখলদার, টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যু, মৌসুমী ইজারাদার, ঝুট ব্যবসায়ী, পরিবহন চাঁদাবাজ, প্রতারক, টাউট-বাটপার, কি নেই এই অঞ্চলে? এখানকার জুয়ার টেবিলে উড়ে লাখ-কোটি টাকা। ইচ্ছে হলেই এখানকার টাকাওয়ালারা ভ্রমনের নামে বিদেশে উড়ে গিয়ে ডিসকো ক্লাবে উড়ান ডলার, পাউন্ড, বাথ, রুপি। অনেকের রয়েছে রঙ মহল। মদের নেশায় বুদ হয়ে অনেকে থাকেন বেসামাল। তাহলে সাভার-আশুলিয়ায় কেন নেই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত শুদ্ধি অভিযানের আঁচ- এ প্রশ্ন এখন চায়ের টেবিলের আড্ডায়, ড্রয়িং রুমে, পক্ষান্তরে সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ঘোষণা মতে, অভিযানের ব্যাপ্তি জেলা-উপজেলা ও পৌর এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে। তাই দেশের অন্যতম শিল্পাঞ্চল সাভার-আশুলিয়ার ১০ লক্ষাধিক মানুষের মনের অনেক অজানা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সাভার-আশুলিয়ায় আইনশৃক্সখলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সম্মিলিত শুদ্ধি অভিযান এখন সময়ের দাবি।
সূত্রঃসাভারসংবাদ
Leave a Reply