সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলী আর নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক, মোহাম্মদ আদনান মামুন:
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলী আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলীর মৃত্যুর খবরে তাঁর নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর তথা শ্রীপুরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
অ্যাডভোকেট রহমত আলীর ব্যক্তিগত সহকারী এসএম জাহাঙ্গীর আলম সিরাজী বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, দীর্ঘদিন তিনি ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে ভুগছিলেন।
তিনি আরও জানান, রোববার বাদ জহুর পশ্চিম ধানমন্ডি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে, বিকেল চারটায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়, বাদ এশা ঢাকার এ্যালিফেন্ট রোডের বায়তুল মামুর জামে মসজিদ ও আগামীকাল দুপুরে সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণে আপাতত জানাযার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, এছাড়াও আরও কয়েকটি স্থানে জানাযা হওয়ার কথা রয়েছে ও মঙ্গলবার মরহুমের জন্মস্থান গাজীপুরের শ্রীপুরে জানাযার হওয়ার পর শ্রীপুরে দাফনের কথা রয়েছে।
মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। মরহুমের বড় ছেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জাহিদ হাসান তাপস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছোট ছেলে অ্যাডভোকেট মো. জামিল হাসান দুর্র্জয় গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক। তার একমাত্র মেয়ে রুমানা আলী টুসী একাদশ জাতীয় সংসদে ১৪নং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য।
১৯৪৫সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় বড়বাড়ি গ্রামে জন্ম। তাঁর বাবার নাম মো: আছর আলী, মা শুক্কুরজান বিবি।
অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলীর রাজনৈতিক সহযোগীরা জানান, তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল দেশ গড়ার ইতিহাস, তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। তিনি সততা ও আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের পরম আদর আর ভালোবাসার লড়াকু এই সৈনিকের হাতে কত নেতার যে জন্ম হয়েছে তার আর হিসেব নেই। অনেকটা বুকে জড়িয়ে রেখেই তিনি রাজনীতি শিখিয়েছেন। সবকটা নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলন, ৬৬ এর ৬-দফা, ৬৯ এর গণ আন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন এড. রহমত আলী। শ্রীপুর-কালিয়াকৈরের মানুষ তাঁকে “উন্নয়নের রূপকার” উপাধিতে ভূষিত করেছেন। স্বাধীনতার পর এই এলাকায় যতো উন্নয়ন হয়েছে সবগুলো তিনিই করেছেন।
১১বৎসর বয়সে ছাত্রলীগে সক্রিয় হয়ে সে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়ে তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালে ৭ই জুন তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মিছিলে নেতৃত্ব দান এবং গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন।
অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলীর সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য এড. হারুন অর রশিদ ফরিদ জানান, ১৯৬৮ সালে ঢাকা জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গতাজ তাজ উদ্দিন আহমদের পক্ষে প্রচারণার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতার ৮ নাম্বার থিয়েটারের সাথে মি: বুশ ও জি এম চ্যার্টাজীর সাথে সমন্বয় ও ফ্লাইট কুরিয়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন, ১৯৭২ সালে ১৯শে এপ্রিল ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কৃষকলীগের গঠিত কমিটিতে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শতাধিক বস্তিবাসি পরিবারকে দিনাজপুরে পুর্ণবাসিত করেন, ১৯৭৪ সালে কৃষকলীগের সাধারন সম্পাদক এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে ১০ই জুলাই মতিঝিলের কমাশির্য়াল কো অপারেটিভ ব্যাংক থেকে গ্রেফতার এবং ২ বছর ৮ মাস ১৭ দিন কারাভোগ করেন। ১৯৮৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন।
তিনি জানান, ১৯৮৬ সালে কৃষকলীগের সভাপতি, ১৯৯০ সালে ২৯ নভেম্বর গ্রেফতার হন। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে পরপর বিপুল ভোটে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদ প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৯ সালে ২৮ ডিসেম্বরে মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। ১৯৯৬ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর সংসদের বিশেষ কমিটির সভাপতি, ১৯৯৬ সালে ১ সেপ্টেম্বরে স্থানীয় সরকার কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সংসদীয় কমিটির সভাপতি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি সভাপতিসহ অনেক গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি আরও জানান,, জীবনের সব কিছু উজার করে সততা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেমের মাধ্যমে বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়ে কর্মী তৈরী করেছেন, সার্বিক উন্নয়ন করেছেন। নিরহংকারী, শিক্ষানুরাগী, আদর্শ রাজনীতিবিদ হিসেবে তার সুনাম ছিল।
গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের শোক ঃ বর্ষীয়ান আওয়ামীলীগ নেতার মৃত্যুতে নানা কর্মসূচী পালন করছে গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগ ও সহযোগী অঙ্গসংগঠন। জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক গাজীপুর ৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজ জানান, মরহুমের মৃত্যুতে জেলার সকল উপজেলায় দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে এছাড়াও মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া, মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের কর্মসূচী ঘোষনা করা হয়েছে। এডভোকেট রহমত আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন গাজীপুর-১ আসনের সাংসদ মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এডভোকেট আকম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি এডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, গাজীপুর-২ আসনের সাংসদ যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর-৪ আসনের সাংসদ সিমিন হোসেন রিমি, গাজীপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, গাজীপুর সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, প্রমুখ।
বিএনপির শোক: বর্ষীয়ান আওয়ামীলীগ নেতা রহমত আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য চৌধুরী তানভীর সিদ্দিকী, সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন, সাধারন সম্পাদক কাজী সাইদুল আলম বাবুল, কেন্দ্রীয় বিএনপি সহস্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা: রফিকুল ইসলাম বাচ্চু প্রমুখ।
এলাকায় শোকের ছায়া: রহমত আলীর মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রাজনীতিতে প্রতিহিংসা ভুলে সহাবস্থানের রাজনীতির মডেল গড়ে তুলেছিলেন তিনি গাজীপুরে। দক্ষ এই সংগঠকের কারনে গাজীপুর হয়ে উঠেছিল ভোটের রাজনীতির ময়দানে আওয়ামীলীগের ঘাঁটি হিসেবে। দলমত নির্বিশেষে রহমত আলী সবার কাছেই ছিল খুব জনপ্রিয়। ভোটের রাজনীতিতে তিনি কখনও পরাজিত হননি। গাজীপুরের উন্নয়নের জন্য তিনি সবসময় সোচ্চার থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও আদর্শ রাজনৈতিক কর্মী গঠনে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।
Leave a Reply