রাত পোহালে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন, ‘ প্রশাসনিক ব্যবস্থা জোরদার’ ভোটের মাধ্যমে ক্ষনগননার পালা কে জিতবেন আর কে হারবেন!
শেখ এ কে আজাদঃ ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার শেষ। এখন ক্ষনগননের ভোটের অপেক্ষা করতে হবে ভোটারদের। আজ রাত পোহালেই শুরু হচ্ছে সিটি নির্বাচনে ভোটের উৎসব। এবারে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন। ঢাকার অলি-গলিতে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকসহ ছেয়ে গেছে কাউন্সিলর প্রার্থীদের পোষ্টারে গোটা সিটি।
এছাড়া নেতাকর্মীদের উৎসবমুখর পরিবেশে ২০ দিন ধরে ঢাকা নগরী পরিণত হয়েছিল আশা,প্রত্যাশা প্রচারনার মহানগর। কারও নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেনি। ফলে এবারের নির্বাচনী প্রচারের পরিবেশ নিয়ে কমিশন প্রথম থেকে সন্তুষ্ট ছিলো জানিয়ে গত ২২ জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা এই পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
এ নির্বাচনী প্রচারও ছিল উৎসবমুখর পরিবেশে। আর উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারের কারণে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের কমতি নেই সাধারন মানুষের মধ্যে। সিটির ৫৪ লাখ ভোটারের পাশাপাশি সারাদেশের ১৬ কোটি মানুষেরও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু পরিনতি এখন এই সিটি নির্বাচন।
কে জিতবেন, কে হারবেন সেটা নিয়ে প্রার্থীদের পাশাপাশি সিটিসহ দেশবাসীও এখন হিসাব করতে শুরু করে দিয়েছেন। মূলত এটি স্থানীয় নির্বাচন হলেও ঢাকার দুই সিটিতে জাতীয় নির্বাচনের মত করে আলোচনা বইছে চারদিকে। এদিকে নির্বাচনে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরা মাঠে থাকছেন। দেশী -বিদেশী পর্যাবেক্ষক থাকছেন এ নির্বাচন মাঠে।
জয়ের আশা নিয়ে প্রার্থীরা মাঠ চষে বেড়িয়েছেন প্রার্থীরা। ভোট ও সমর্থন চেয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা। মেয়র পদে দুই সিটিতে ১৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এবারে মেয়র পদে এবার কোন স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই।
গত ১০ জানুয়ারি থেকে নির্বাচনী প্রচারনা শুরু হয়ে মাঠে ছিলেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। তবে এই দীর্ঘ সময়ে নির্বাচনী প্রচারে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সকল দলের মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীর পোস্টারে ছেয়ে গেছে গোটা ঢাকা মহানগর।
অনেক ভোটারদের মতে, অন্য যে কোন নির্বাচনের চেয়ে ঢাকা সিটি নির্বাচনের প্রচার ছিল এবার উৎসবমুখর। রাতদিন প্রার্থীরা ভোট প্রার্থনায় মাঠ চষে বেড়িয়েছেন । প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম ও বিএনপির তাবিথ আউয়াল; দক্ষিণে আওয়ামী লীগের ফজলে নূর তাপস এবং বিএনপির ইশরাক হোসেন নির্বাচনী প্রচারে যেখানেই গিয়েছেন হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক তাদের সঙ্গে হাজির ছিলেন। নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত অবস্থায় উৎসবমুখর পরিবেশে তারা ভোট চেয়েছেন।
তবে নির্বাচনী প্রচারের পরিবেশ ছিল বেশ শান্ত ও নির্বিঘ্ন। এছাড়া সব প্রার্থীর পক্ষেই সাউন্ড রেকর্ডার ব্যবহারসহ সঙ্গীতের মাধ্যমে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ভোট প্রার্থনা করা হয়। পাড়া-মহল্লায় সর্বত্র মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচার প্রচারনা চালিয়েছেন প্রার্থীরা।
এদিকে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ইমেজ রক্ষার নির্বাচনও বটে। ফলে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণে এই নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে দুই দল আশাবাদ প্রকাশ করেছেছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া রয়েছে।বহিরাগত লোকদের কেন্দ্রে না থাকার জন্য বলেছেন সিইসি। এবার ঢাকা সিটিতে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেয়া হবে।
ইভিএমে ভোটে শঙ্কা দূর করতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ইভিএম প্রদর্শনী করা হয়েছে।
এছাড়া লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে বিএনপির প্রার্থীরা কিছু অভিযোগ করলেও ভোটের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে তারাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এই চার প্রার্থীর বাইরে বাকি মেয়র প্রার্থীরাও নির্বাচনে জয়ের আশাবাদ নিয়ে ভোটের মাঠ তারাও চষে বেড়িয়েছেন। তবে এই নির্বাচনে কে জিতবেন, কে হবেন নগরপিতা হিসেবে ক্ষনগননায় শনিবার চূড়ান্ত করবে ভোটাররা।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১ জন করে মেয়র পদ ছাড়া ঢাকা উত্তরে ৫৪ সাধারণ কাউন্সিলর ও ১৮ সংরক্ষিত কাউন্সিলর, দক্ষিণে মেয়র পদের পাশাপাশি ৭৫ কাউন্সিলর ও ২৫ সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দেবেন ভোটাররা।
এদিকে প্রার্থীরা নির্বাচনে শতভাগ জয়ের যেমন প্রত্যাশা করছেন তেমনি ভোটারদের কাছে দিয়েছেন নানা প্রতিশ্রুতি। ঢাকার নাগরিক জীবনের সব ধরনের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি উন্নত ও দূষণমুক্ত ঢাকা গড়তে ভোটারদের কাছে অঙ্গীকার করেছেন। প্রচারের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা সব সময় ছিলেন খবরের প্রধান শিরোনামে। ফলে ভোটারদের আগ্রহ ছিল এই চার প্রার্থীকে ঘিরেই।
নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি প্রায় সব মেয়র প্রার্থী করণীয় অগ্রাধিকার দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন আগে ভাগেই। উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ২৬ জানুয়ারি, বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ২৭ জানুয়ারি ইশতেহার ঘোষণা করেন। আর ২৮ জানুয়ারি দক্ষিণ সিটিতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ইশরাক হোসেন এবং ২৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস ইশতেহার দেন। এসব ইশতেহারে তারা ঢাকার মূল সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিয়ে সেগুলো সমাধানের অঙ্গীকার করেছেন। প্রতিশ্রুতি দেন আধুনিক সচল ঢাকা গড়ার। এছাড়াও সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি এসেছে তাদের মুখ থেকে। মেয়রদের প্রতিশ্রুতির পালা শেষে এখন ভোটারদের সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। রাত পোহালে তাই ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করবেন।
এদিকে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন শুধু মেয়র প্রার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই নির্বাচন ঘিরেই এখন দেশের রাজনীতিও আবর্তিত হচ্ছে। দুই দল নির্বাচনে জিতে জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে চায়।
এদিকে বিএনপির উদ্দেশে অভিযোগ করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেছেন,
সিটি নির্বাচন বাতিল করতেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। নির্বাচনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মানসিকতা নেই। পরাজয়ের আশঙ্কা থেকেই নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ তুলছে বিএনপি।
এদিকে সুশীল সমাজের ভাবনা এই সিটি নির্বাচন ঘিরে। নির্বাচনে ভোটারদের আস্থা ফেরাতে সুষ্ঠু নির্বাচনেরই প্রত্যাশা করছেন তারা। বসে নেই কূটনীতিকরাও।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলারও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার আশবাদ ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে এবং কমিশনের প্রস্ততি দেখতে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি বলেছেন, আশা করি উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের সব ধরনের প্রচার শেষ বৃহস্পতিবার মধ্য রাত থেকেই । প্রশাসনিক নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে পুরো ঢাকা সিটি। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বৃহস্পতিবার থেকে মাঠে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নির্বাচনের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে ইসির অধীনে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ঢাকার দুই সিটিতে মোট ৬৫ প্লাটুন বিজিবি টহল দিচ্ছে। এর মধ্যে উত্তরে ২৭ প্লাটুন এবং দক্ষিণে ৩৮ প্লাটুন বিজিবি সদস্য ভোটের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। আরও ১০ প্লাটুন বিজিবি রিজার্ভ রাখা হয়েছে প্রয়োজনের মুহূর্তে মোতায়েনের জন্য।এদিকে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকলেও সেনাবাহিনী মোতায়েন করার কোন সিদ্ধান্ত নেই নির্বাচন কমিশনের। তবে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট গ্রহণের কারণে ইভিএম পরিচালনায় কারিগরি টিমের সদস্য হিসেবে প্রতিকেন্দ্রে ২ জন করে সেনা সদস্য মোতায়েন থাকছেন। যারা মূলত ইভিএম পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। ইসি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে ২ হাজার ৪শ’ ৬৮টি ভোট কেন্দ্রে ইভিএম পরিচালনার জন্য দায়িত্বে থাকবেন সশস্ত্র বাহিনীর পাঁচ হাজারের বেশি সদস্য। যারা দায়িত্ব পালন করবেন সব ভোটকেন্দ্রে। এদিকে ইভিএম পরিচালনায় দায়িত্বরত নিরস্ত্র সেনা সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনী সব পদক্ষেপ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে সেনাক্যাম্প স্থাপন অথবা প্রশাসনিক সুবিধাদানকারী ডিভিশনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। ইভিএম বিষয়ক এক বিশেষ পরিপত্র জারি করে এমন নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ইসির অধীনে গঠিত আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় ও মনিটরিং সেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অর্ধলক্ষ সদস্য মাঠে থাকছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমদের নেতৃত্বে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন সদস্যদের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স নির্বাচনী এলাকায় টহলে থাকবেন। আর পুলিশসহ অঙ্গীভূত আনসার ও ভিডিপির সদস্যরা থাকবেন কেন্দ্রে কেন্দ্রে।
কেন্দ্রগুলোতে পুলিশ ও আনসার-ভিডিপির সদস্য থাকছেন ৪১ হাজার ৯৫৬ । পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে গঠিত ১২৯টি মোবাইল ফোর্সে থাকবেন ১ হাজার ২৯০ জন। ৪৩টি স্ট্রাইকিং ফোর্সে থাকবেন ৪৩০ জন, রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্সে থাকবেন ৫২০ জন। দুই সিটিতে র্যাবের টিম থাকবে ১৩০টি। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে টিম দায়িত্ব পালন করবে। গড়ে ১১ জন করে এতে মোট ১ হাজার ৪৩০ র্যাব সদস্য থাকবেন। দুই সিটিতে র্যাবের ১০টি রিজার্ভ টিম থাকবে, তাতে ১১০ সদস্য থাকবেন। রিজার্ভসহ দুই সিটিতে ৭৫ প্লাটুন বিজিবি দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতি প্লাটুনে গড়ে ৩০ জন করে মোট ২ হাজার ২৫০ জন বিজিবি সদস্য থাকবেন ভোটের দায়িত্বে।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে’ জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কোথাও কোন ঝুঁকি তিনি দেখছেন না।
Leave a Reply